ATEXSA

নানা রঙের দিনগুলি

নানা রঙের দিনগুলি
মোহাম্মদ উজ্জ্বল মিয়া (উজ্জ্বল আবির)
ব্যাচ: ১৯৯৩
ক্লাস রুমে পা দিয়েই সদ্য সহপাঠী হয়ে উঠা সকলের থমথমে মুখ দেখেই আৎকে উঠেছিলাম। স্কূলের ছাত্রছাত্রীদেরকে সেদিন কিসের যেনো টীকা দেয়ার কথা ছিল। ক্লাসের সবার মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। কোন এক বন্ধু এসে খবর দিয়েছিল যে, সুঁচ অনেক বড়। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পাশেই ছিল ম্যাডামদের অফিস রুম। সামনের দরজা দিয়ে পালানোর কোন উপায় ছিল না। সাহসী কিছু বন্ধুর অনুসরণ করে ক্লাসরুমের জানালার ফাঁক গলে স্কুল থেকে পালালাম। সে সময় ক্লাস রুমের জানালার গ্রিলগুলি অস্ভাবিক রকমের ফাঁকা ফাঁকা ছিল। চার পাঁচ বছরের বাচ্চাদের জন্য জনালার গ্রিল দিয়ে বের হতে পারাটা মোটেও অসম্ভব ছিল না। তাছাড়া সেসময়ে স্কুলের প্রায় সব ক্লাস রুমেরই জানালার গ্রিলের রডগুলি পালানোর উপযোগী করে বাঁকানো ছিল। হয়তোবা অগ্রজরা অনুজদের স্কুল পালানোর পথ তৈরী করেই রেখেছিল। এটাই ছিল প্রথম স্কুল পালানো। শিশু শ্রেণীর স্মৃতি বলতে এতটুকুই যা মনে পড়ে। সেই ১৯৮২ সালের কথা।
প্রথম শ্রেণীতে বাঙলা পড়াতেন যে ম্যাডাম, উনাকে আমরা ডিসকো আপা বলে ডাকতাম। উনার প্রকৃত নাম আমার মনে নেই। তিনি খুব অল্প সময় স্কুলে টিচার হয়ে ছিলেন। উনি ছড়া পড়াতেন চমৎকার ভঙ্গিমায়। হাত নেড়ে নেড়ে অভিনয় করে। মনে হয় এই অদ্ভুত পাঠদান রীতির জন্যই আমরা উনাকে ডিসকো আপা ডাকতাম।
ক্লাস টুতে আমাদের ইংরেজী পড়াতেন ছোট আপা। উনাকে ছোট আপা কেন ডাকা হতো তা আমার জানা নেই। হয়তো আকৃতির একটা ব্যাপার ছিল। রড় আপাকে আমরা পেয়েছিলাম পুরো স্কুলের সময়টাতেই। যিনি আমাদের ভবিষৎ দুশ্চিন্তায় আবেগপ্রবন হয়ে ক্লাসে চোখের পানি ফেলতেন্। আর ছোট আপা আমাদের দিয়েছিলেন পরম স্নেহ। কিন্তু তিনি বেশী দিন ছিলেন না স্কুলে। আমাদের সময়ে টিচাররা ক্লাসে বেত নিয়ে আসতেন। পড়া না পারলে বা হোম ওয়ার্ক না করলে শারিরীক শাস্তিভোগ আমাদের জন্য ছিল ডালভাত। তবে ছোট আপা বৃদ্ধাংগুল ও কণিষ্টাংগুলের পরিধি দিয়ে এমন ভাবে পিঠে চাপড় দিতেন যে এটা আদর ছিল না শাস্তি তা আজও আমার কাছে রহস্য হয়েই রইল।
আমরা তৃতীয় শেণীতে পড়ার সময়ে স্কুল পেয়েছিল একঝাক নতুন টিচার। সোহরাব স্যার, নাহাশ পাশা স্যার, মাহবুব স্যার, সাধন স্যার এবং হাই স্যারের মতো স্বনামধন্য শিক্ষক । নাহাশ পাশা স্যার আমাদের পিটি করাতেন। কিন্তু তিনি আমাদের মতো ছোট বাচ্চাদের কিছু ক্লাসও নিতেন। মাজার ব্যাপর হলো উনি আমাদের ক্লাসে গান শুনাতেন। একজন টিচার যে ক্লাসে গানও শুনাতে পারেন তা উনাকে না পেলে আমরা জানতেও পারতাম না। আর সিরাজ স্যার ছিলেন সবচেয়ে বন্ধুসুলভ এবং মাই ডিয়ার টাইপ টিচার। উনার কিছু কিছু বিখ্যাত ডায়লগ ছিল ছাত্রদের মুখে মুখে। কোন এক ওপেন সিক্রেট কারণে পরীক্ষার হলে সিরাজ স্যারকে গার্ড হিসাবে পেতে চাইতো সব স্টুডেন্টরা।
মোহসেনা আপা চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাস টিচার ছিলেন। উনার কড়া শাসনে ক্লাস সব সময় তটস্থ থাকতো। কোন একদিন ক্লাস চলাকালীন বন্ধু রিতুল আমার পেছনের বেঞ্চে বসে আমাকে পেন্সিল দিয়ে খোঁচা দিচিছল। বেশ কয়েকবার না করার পরও ওর খোঁচাখোঁচি বন্ধ হচিছল না। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পেছন ফিরে আমিও দিলাম পাল্টা খোঁচা। ভাগ্য ভালো যে টার্গেট মিস হয়েছিল। পেন্সিলের খোঁচা ওর আইব্যুরো ছুঁয়ে কপোলে এসে ঠেকেছিল। অবধারিতভাবে বিচার গেলো মোহসেনা আপার কাছে। উনি দুজনের বক্তব্য শুনে দুজনকেই বেত দিয়ে একটি করে পিটুনি দিয়েছিলেন। উনার সুশাসনে আমি যার পর নেই সেরকম মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল উনি শুধু আমাকেই মারবেন। কারণ, রিতুলতো শুধু আমার পিঠে খোঁচা দিয়েছিল, আর আমিতো তার চোখের মণি ফুটো করার আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম।
১৯৮৭ ইং সালে আমরা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তাম। অনেক কারণেই ঐ বছরটি উ্ল্লেখযোগ্য ঘটণাবহুল ছিল। প্রাথমিকের শেষ ক্লাস। যদিও এখনকার মতো সমাপনী কোন পরীক্ষা ছিল না। তবে বৃত্তি পরীক্ষা দেবার একটা ব্যাপার ছিল। প্রথম অথবা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় যারা প্রথম দিকে থাকতো তারাই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারতো। প্রয়াত মিজান স্যারের নেতৃত্বে বৃত্তির জন্য নির্বাচিতদের জন্য বিশেষ কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করা হতো। মিজান স্যারের হাতের লেখা অনেক সুন্দর ছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম একজন মানুষের হাতের লিখা এতো সুন্দর হয় কি করে। উনি শাসন এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণের সহযোগে অদ্ভুত কায়দায় ক্লাস নিতেন। টিফিনের পর আমাদের বৃত্তির কোচিং হতো। আমরা বাসা থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে কোচিং করতে যেতাম। একদিন মিজান স্যার বললেন যে, উনি আমাদের হাত শুকে বলে দিতে পারবেন আমরা টিফিনে কি খেয়ে এসেছি। আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমাদের মধ্যে কয়েকজন স্যারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন। স্যার সত্যি সত্যিই বলে দিতে পেরেছিলেন তারা কি খেয়ে এসেছিল।
ছোট বেলা থেকেই অপেক্ষা করছিলাম, কোনদিন ক্লাস সিক্সে উঠবো। এই ক্লাস থেকেই পাঠ্যবই গুলি আকারে ছোট হয়ে যেতো। বড় ভাইরা খুব কায়দা করে খাতার ভাঁজে ছোট বইগুলিকে পেঁচিয়ে যখন স্কুলে যেতো তখন আমার খুব আজ্ঞেপ হতো এই ভেবে যে, ছোটদের বইগুলি এতা বড় কেন। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে, আমাদের সময়ে স্কুলব্যাগের কোন বালাই ছিল না। আমরা প্রায় সকলেই হাতে করে বই খাতা আর বুকের পকেটে পেন্সিল কলম নিয়ে স্কুলে যেতাম। বড়জোর কেউ কেউ জ্যামিতি বক্স বা পেন্সিল বক্স বহন করতো বিশেষ প্রয়োজনে। ক্লাস সিক্সে আমরা পাঠ্য হিসাবে পেয়েছিলাম পূর্ণাঙ্গ বাঙলা উপন্যাস ‘জোহরা’। এ উপন্যাসের এক বিশেষ অবদান রয়েছে আমাদের জীবনে। ছোট আকারের পাঠ্যবই আর ‘জোহরা’ উপন্যাসে মানব মানবীর অকৃত্রিম সম্পর্কের টানাপোড়েন আমাদেরকে অনেক বড় বানিয়ে দিয়েছিল ছোট বয়সেই।
সপ্তম শ্রেণীতে আমরা দুজন অংকের টিচার পেয়েছিলাম। প্রথম দিকে সাধন স্যার অংক করিয়েছিলেন্। আগেই বলেছি যে,তখনকার সময়ে টিচাররা ক্লাসে বেত নিয়ে আসতেন। তবে সাধন স্যার বেত নিয়ে আসতেন না। কাউকে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন হলে উনি ডাস্টার ছুড়ে মারতেন। তাঁর চোখের বিশেষত্বের কারণে কিংবা অন্য কোন পারদর্শিতার জন্যই কি না জানি না, সাধন স্যারের নিশানা অব্যর্থ ছিল। বদলিজনীত অথবা অন্য কোন অনিবার্য কারণে সাধন স্যার স্কুল ছেড়ে গেলে অংকের টিচার হিসাবে পেয়েছিলাম রঞ্জিত স্যারকে। ফাইনাল পরীক্ষার আগে আমরা উনার কাছে সাজেশন চেয়েছিলাম। রঞ্জিত স্যার সাজেশন দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। আমাদের পিড়াপীড়িতে উনি বেশ স্মার্টলি বলেছিলেন, যে অংকগুলি পরীক্ষায় আসবে না সেগুলিই আমি সাজেশনে হিসাবে দেব। উনার কথায় আমরা রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। বললাম তাই দেন স্যার। সে সময়ে উনার বেকায়দায় পড়া চেহারাটা দেখার মতো হয়েছিল।
মর্তুজা স্যার ওরফে মৌলভী স্যার সাধারণত হাই স্কুলের প্রায় সব ক্লাসেরই ইসলাম ধর্ম বিষয়টি পড়াতেন। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করার প্রয়াশে কিনা জানি না উনি অষ্টম শ্রেণীর ক্লাস টিচার হয়ে বাঙলার ক্লাসটি নিতেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো উনার মতো এতো মজা করে বাঙলা পড়াতে আমি আর কোন টিচারকে দেখিনি। পড়াতে গিয়ে তিনি কিছু কিছু প্রাসঙ্গিক গল্পের অবতারণা করতেন। যার কিছু কিছু আমার এখনো মনে আছে। এটি কেবল সম্ভব হয়েছে মৌলভী স্যারের অনন্য পাঠদান রীতির কারণেই। আমাদের অনেক প্রিয় শিক্ষকের মৃর্ত্যুর মতোই্ উনার আকস্মিক চলে যাওয়া ধারুণ ভাবে মর্মাহত করেছিল আমাকে।
শিক্ষাবোর্ডের রেজিস্ট্রেশন করতে হতো নবম শ্রেণীতে। এ রেজিস্ট্রেশন এসএসসি পরীক্ষার আবহ সঙ্গীতের মতো ছিল। কে সায়েন্স নিবে, কে আর্টস বা কমার্স তা নির্ধারণ করতে হতো এ রেজিস্ট্রেশনে। হঠাৎ করেই সবাই সত্যিকারের বড় হয়ে যেতো। ভবিষৎ ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিতো। শুধু ক্যারিয়ার না, এই ক্লাসে অনেকেই ভীরু ভীরু মন নিয়ে বপন করে নিতো নানা রঙ্গীন স্বপ্ন।
প্রতিটি ব্যাচের সবচেয়ে আনন্দময় সময় মনে হয় কেটেছে দশম শ্রেণীতে। স্কুলের অনেক কাজের কাজী হতে হয় এই ক্লাসের স্টুটেন্ডদের। দশম শ্রেণীতে উঠার পরপরই ভলেন্টার হিসাবে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ দিনটি শুধু স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্যই নয় বরং পুরো কলোনীবাসীদের জন্যই ছিল বিশাল উৎসবের উপলক্ষ্য। আর এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উপভোগ করার জন্য অনেকের গ্রামের বাড়ী থেকে আত্মীয় স্বজনরাও চলে আসতো। নির্মল আনন্দের এ সর্বজনীন উৎসব প্রাণ ছুঁয়ে যেতো আমাদের সবারই।
একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে দশম শ্রেণীর ছাত্ররা রাত জেগে শহীদ মিনার সাজাতো, মাইকে দেশের গান বাজাতো, পোস্টারিং করতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া দিতো আর সকালের প্রভাতফেরির আয়োজন করতো। আহ্ কি উত্তেজনার সময়ই না ছিল সেটা। সেই রাতের কত মধুর স্মৃতি আজও অম্লান হয়ে আছে মনের পাতায়। শহীদ দিবসের যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে সবকিছু ঠিকঠাক মতো করার জন্য আমাদের যে প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল তা পরবর্তীতে বড় পরিসরে অনেক কিছু করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে নিঃসন্দেহে।
এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান এবং বার্ষিক মিলাদ মাহফিল আয়োজন ছিল আরো একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিউ টেনের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত হল ডেকোরেট করা, বিদায়ী ভাই বোনদের জন্য গিফট কেনা, মানপত্র প্রস্তুত করা, মিলাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা, শিক্ষক শিক্ষিকা এবং সংশ্লিষ্ট অফিস স্টাফদের জন্য(এখানে রশিদ ভাইয়ের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য) স্বারক সম্মাননার ব্যবস্থা করা। কতো কাজ, কী যে উত্তেজনা! প্রতিটা কাজের জন্য আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে সুচারুভাবে সব কিছু সম্পন্ন করতে পারা কতো আনন্দের ছিল তা বলে বুঝানো যাবে না।
এরপর ক্রমান্বয়ে চলে আসে প্রথম সাময়িকী, প্রিটেস্ট, টেস্ট পরীহ্মা। পড়াশোনার চাপ বাড়তে থাকে। সারা বছর ফাঁকি দিয়ে চলা ছেলে কিংবা মেয়েটিও জান প্রাণ দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে এসএসসি পরীহ্মার জন্য। ক্লাস টেনে মান্নান স্যার, লাইলী আপা, সায়েদা আপাসহ সংশ্লিষ্ট সকল টিচারদের অকৃত্রিম ভালবাসা পেয়েছিলাম। এ ক্লাসে এসে মনে হয় টিচাররা সবচেয়ে বেশী ফ্রেন্ডলী হয়ে যেতো। হয়তো তাঁদের ভেতরত্ত সম্ভাব্য বিরহের সুর বেজে উঠতো। শিশু শ্রেণী হতে দশম শ্রেণী, এগার বছরের এ জার্নি শেষ হতো এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আসলে কি শেষ হয়! কখনো না। এ বন্ধন থেকে যায় পুরো জীবনব্যাপী, হয়তো জন্মান্তরেও।
১৯৯৩ সাল। প্রিয় স্কুল থেকে আমাদের বিদায়ের বছর। কত মিশ্র অনুভূতির অমলিন স্মৃতি। কোনটা রেখে কোনটা বলি। তখনতো আর ডিজিটাল ক্যামেরা কিংবা এখনকার মতো মেগা মেগা পিক্সেলের মোবাইল ক্যামেরা ছিল না। আমরা ধার করা এনালগ ক্যামেরা নিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে ফুজি বা কোডাকের ফটো ফিল্ম কিনে বিদায়ের মহেন্দ্রক্ষণকে ধারণ করেছিলাম। সে ছবি গুলি আমাদের সবার জীবনেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ স্বরূপ বহুযতনে সংরক্ষিত আছে। নিশ্চিতভাবেই থেকে যাবে আজীবন। আমরা এ্যালবামের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বার বার ফিরে যাই আমাদের অতিপ্রিয় সেই সময়ে, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতির জগতে। আমার মনে হয়, আমরা যদি কোন এক জাদুর কাঠির স্পর্শে সত্যি সত্যিই স্কুল জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাই, তাহলে এমন একজনও খোঁজে পাওয়া যাবে না যে সেই লাইফে ফিরে যেতে চাইবে না। আমিতো বার বারই ফিরে যেতে চাই সেই সোনালী সময়ে।
আমরা নব্বইয়ের দশকের তরুণ তরুণীরা নিঃসন্দেহে অনেক ভাগ্যবান ছিলাম। আমরা এনালগ এবং ডিজিটাল জগতের সেতুবন্ধন তৈরী করেছিলাম। আমরা চিঠি লিখে লিখে প্রেম করেছি, আবার প্রযুক্তির অত্যাধুনিক সেবারও সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছি। সেই দশকে সারা বিশ্বজুড়েই কালজয়ী গান, সাহিত্য আর মুভির সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে, কিন্তু নাইনটিস্ একটি মাইল ফলক দশক হিসাবে থেকে যাবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তাছাড়া আমাদের স্কুল জীবন স্কুলের গন্ডির ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিল না। আমাদের শৈশব, কৈশোর আর যৌবন কেটেছে কলোনীর বিশাল খোলা প্রান্তরে। স্কুল সময়ের পর বিকালের আড্ডা আর খেলাধুলার পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ বিল্ডিংয়ের সামনে আশেকানদেরকে চক্কর মারতে দেখা যেতো। কলোনীর ক্লাব রাজনীতি, আবাহনী মোহামেডন ফ্যানদের বিজয়োল্লাস, কালেভাদ্রে রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলে আনন্দ উল্লাসে আত্নহারা হওয়া, তারাবী, শবেবরাত বা কদরের নামাযের ছুতোয় রাতের আনন্দ আড্ডা আর নানা রোমাঞ্চকর কর্মকান্ড সংঘটিত করা, ঈদের সময় দলবেঁধে ঘুরাঘুরিঁ, রোজার সময়ে ইফতারের সময়ে পাওয়ার হাউজের সাইরেনের মতোই কখন যে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়ে আমাদেরকে বড় করে দিয়ে গেছে তা আজও টের পাইনি।
১৯৯৩ ব্যাচের কিছু কিছু অনন্য কর্মকান্ড বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রেরণার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের এই ব্যাচটি টিচারদের সকল দুর্ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে শতভাগ পাশের গৌরব অর্জন করেছিল। ক্লাসের কোন বন্ধু বা বান্ধবীর স্কুল বা কলোনী ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে বিদায় সম্বর্ধণা দেয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল এ ব্যাচটিই। তিরানব্বই ব্যাচ প্রতি বছর রোজার মধ্যে স্কুল প্রাঙ্গণে ইফতার পার্টির আযোজন করতো, যার ধারাবাহিকতায় এখনো ঢাকার রমনা পার্কে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়। এসএসসি পরীক্ষার পর কলোনীতে আমরা সবাই একটি করে বৃক্ষ রোপন করেছিলাম। যার কিছু কিছু এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। কলোনীর হাসপাতাল ও অডিটরিয়ামের সামনের কড়ই গাছ এবং স্কুল বিল্ডিংয়ের পশ্চিম দিকের গেটের পাশের চমন বাহার গাছটি এ ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারাই রোপন করা হয়েছিল। আমার সৌভগ্য যে আমি এমন একটি ব্যাচের সদস্য হিসাবে চমৎকার একটি বন্ধুমহল পেয়েছিলাম। যাদের সঙ্গ, মেধা ও মনন আমাকে সমৃদ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। আমি এ অবসরে তাঁদের সবাইকে আমার প্রাণের অন্তস্থল হতে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।
রিউনিয়ন সব সময়ই অপার আনন্দের। আর এটা যদি হয় স্কুলের সহপাঠী এবং সমসাময়িক সবার সাথে তাহলে তো কথাই নেই। যেখানে আমরা অনেকে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, শৈশব কৈশোর, যৌবনের উত্তাল সময় কাটিয়েছি, সেখানে সবাই মিলে ফিরে যাবার মতো আর কিছুই হতে পারে না। যারা এই মহৎ উদ্যোগের অংশীদার তারা নিঃসন্দেহে অনেক অনেক প্রশংসার দাবীদার। মানুষ তার সারা জীবনে মনে রাখার মতো যে কয়টি দিন পায় পুনর্মিলনের দিনটি সে রকম একটি দিন হিসাবে জ্বল জ্বল করবে সবার জীবনে। নানা অনিবার্য বাস্তব কারণে যারা এই দিনটি থেকে বঞ্চিত হবে তাদের একজন হিসাবে নিজেকে তোমাদের এ মহেন্দ্রক্ষণে সম্পৃক্ত করার জন্য আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমাদের যে দিনগুলি চলে গেছে, তা আমাদের হৃৎপিন্ডের স্পন্দনে, মস্তিষ্কের অনুরণে থেকে যাবে আজীবন। তাই কবির সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রয়ে গেল, রয়ে যাবে, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।